প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা এর পাঠের গুরুত্ব, প্রধান বৈশিষ্ট্য, পরিধি ও বিষয়বস্তু | অনার্স ২য় বর্ষ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান

প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা এর পাঠের গুরুত্ব, প্রধান বৈশিষ্ট্য, পরিধি ও বিষয়বস্তু, রাষ্ট্রচিন্তায় গ্রিকদের অবদান আলোচনা, অনার্স ২য় বর্ষ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান
Follow Our Official Facebook Page For New Updates


Join our Telegram Channel!

অনার্স ২য় বর্ষ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ


প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা

আধুনিক যুগে সেকুলার রাষ্ট্রচিন্তার সাথে ধর্মাশ্রয়ী চিন্তা এখনও 'প্রাচ্যে কি পাশ্চাত্যে সবক্ষেত্রেই সক্রিয়। প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা মূলত ধর্মতান্ত্রিক এবং অনেকটা নৈতিকতা প্রকৃতির। তবে প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তায় কল্যাণকামী রাজার ধারণার মাধ্যমে রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ধারণার স্বীকৃতি লাভ করে।


প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা


প্রশ্ন ॥ প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা বলতে কী বুঝায়? প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা পাঠের গুরুত্ব আলোচনা কর।


প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা : 

অ-পাশ্চাত্য দেশসমূহ তথা এশিয়া, আফ্রিকার ও দঃ আমেরিকার দেশসমূহ প্রাচ্য দেশ বা অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত। আর প্রাচ্যের যে সকল মনীষী রাষ্ট্র ও রাজনীতি সম্পর্কে যে চিন্তা-ভাবনা করেছেন তাকে প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা বলে । প্রাচ্যের সমাজ, রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে চিন্তাবিদ বা মনীষীদের চিন্তা-চেতনাই প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা। প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তাকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- প্রথমত, প্রাচ্য প্রাচীন রাষ্ট্রচিন্তা। 

প্রাচীনকালে চীনে কনফুসিয়াস, লাওৎসু, মেনসিয়াস, ভারতে কৌটিল্য ও ব্যাবিলনে হাম্বুরাবি প্রাচ্য রাষ্ট্রচিন্তার জগৎকে প্রসারিত করেন। দ্বিতীয়ত, প্রাচ্য মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রচিন্তা। 0মধ্যযুগে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রবর্তিত রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রাচ্য রাষ্ট্রচিন্তার জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে আল ফারাবী, ইবনে সিনা, আল গাজ্জালি, ইবনে রুশদ প্রাচ্য রাষ্ট্রচিন্তায় যথেষ্ট অবদান রাখেন। তৃতীয়ত, প্রাচ্য আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তা। প্রাচ্যের আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তায় অবদান রাখেন সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, মহাত্মা গান্ধী, আল্লামা ইকবাল, মোজাফফর আহমদ, মওলানা ভাসানি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ ।

রাষ্ট্রচিন্তা পাঠের গুরুত্ব: 

আধুনিক বিশ্বের পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার প্রভাব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি প্রাচ্যের-রাষ্ট্রচিন্তার তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক গুরুত্ব বেড়েছে সমান্তরালভাবে। মধ্যযুগের গৌরবময় সময়ে প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা বেশ খ্যাতি অর্জন রাষ্ট্রচিন্তা পাঠের গুরুত্ব অনেক। করে। মূলত চৈনিক, ভারতীয় ও ইসলামি রাষ্ট্রচিন্তার সমন্বয়ে গঠিত রাজনৈতিক চিন্তাধারা ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। 

রাষ্ট্রচিন্তা পাঠের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা :

নিম্নে প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা পাঠের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা আলোচনা করা হলো 

ইসলামি জ্ঞান লাভ : 

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। ইসলামের পরিচয়, উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ, ইসলামের গতিশীলতা, মর্যাদা, অধিকার, দায়িত্ব, কর্তব্য ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা উচিত। আর প্রাচ্যের-রাষ্ট্রচিন্তা অধ্যয়নের মাধ্যমে এ জ্ঞান লাভ করা যায়। তাই প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা অধ্যয়ন করা খুবই প্রয়োজন।

ইসলামি অর্থব্যবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ : 

ইসলামি অর্থব্যবস্থা হলো সুদমুক্ত ও ভারসাম্যপূর্ণ অর্থব্যবস্থা। বিশ্বব্যাপী মানবকল্যাণের লক্ষ্যে এ অর্থব্যবস্থা কাজ করে যাচ্ছে। মানুষের সর্বাঙ্গীন ও সমৃদ্ধ জীবনযাপনের জন্য এ অর্থব্যবস্থা অধ্যয়ন করা প্রয়োজন। 

ইসলামি রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ : 

ইসলামি রাজনীতি, রাজনৈতিক ব্যবস্থা, রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিধি, ক্ষেত্র, ইসলামি রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের উপাদান, গঠন প্রণালি ইসলামি রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য, মূলনীতি প্রভৃতি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে হলে প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা অধ্যয়নের জ্ঞান প্রয়োজন। তাছাড়া ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার সাথে আধুনিক গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক ও ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থার সাথে তুলনাকরণ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা প্রয়োজন। আর এজন্য প্রাচ্যের-রাষ্ট্রচিন্তা অধ্যয়ন করা উচিত।

ইসলামি আইন সম্পর্কে জ্ঞান লাভ : 

প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা ইসলামি আইন সম্পর্কে আলোচনা করে থাকে। ইসলামি আইন কি, আইনের উৎস, বৈশিষ্ট্য, আইন প্রণয়নের পদ্ধতি, অপরাধীর শাস্তি, শাস্তির প্রকৃতি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা অধ্যয়ন করা জরুরি। 

ইসলাম দর্শন সম্পর্কে জ্ঞান লাভ :

ইসলাম একটি সামগ্রিক জীবন দর্শন। ইসলামের আদর্শ, তাওহীদ, আল্লাহর একত্ববাদ, ইসলামে সাম্য, মৈত্রী, ভ্রাতৃত্ব ধর্মনিরপেক্ষতা, মৌলবাদ, খিলাফত, শাসন পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে হলে প্রাচ্যের-রাষ্ট্রচিন্তা অধ্যয়ন করা জরুরি।

তুলনামূলক জ্ঞান লাভ :

ব্যক্তি বা রাষ্ট্রকে উদ্বুদ্ধ করতে তুলনামূলক জ্ঞান করা জরুরি। উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলো তুলনামূলক জ্ঞান লাভ করে উপকৃত হতে পারে। প্রাচ্যের দেশগুলো খনিজ সম্পদ ও জনসম্পদে সমৃদ্ধ হতে প্রাচ্য-রাষ্ট্রচিন্তার তুলনামূলক জ্ঞান লাভ করা প্রয়োজন।

মুসলিম মনীষীদের অবদান সম্পর্কে জানা:

প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে মুসলিম মনীষীদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। তারা প্রাচ্যের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতার উৎকর্ষতার ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও এর বিভিন্ন শাখা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে হলে প্রাচ্যের-রাষ্ট্রচিন্তা অধ্যয়ন করা জরুরি।

চৈনিক জীবনাচার ও মূল্যবোধ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ: 

প্রাচ্যের মোট জনসংখ্যার ৪৫% জনগণ বাস করে চীনে। চীনে কনফুসিয়াসসহ বেশ কয়েকজন দার্শনিক তার দর্শন দ্বারা প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তাকে সমৃদ্ধ করেছেন। প্রাচ্যের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ চিন্তা-চেতনা তথা জীবনাচার, সভ্যতা, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ সম্পর্কে জানতে হলে প্রাচ্যের-রাষ্ট্রচিন্তা অধ্যয়ন করা প্রয়োজন ।

ভারতীয় জীবনাচার ও মূল্যবোধ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ : 

প্রাচীনকাল থেকে ভারতীয় চিন্তাবিদগণ রাষ্ট্রের প্রকৃতি, শাসকের যোগ্যতা, শাসক ও জনগণের সম্পর্ক, জনগণের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করেছেন। ভারতের বর্তমান শাসনব্যবস্থা পূর্বের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলেছে। তাই ভারতের জনগণের জীবনাচার ও মূল্যবোধ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা অধ্যয়ন করা জরুরি।

আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ : 

প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করে থাকে। প্রাচ্যের-রাষ্ট্রচিন্তার পরিধি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপৃত। বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা, বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা, বিশ্বব্যাপী ইসলামের প্রচার ও প্রসার করতে রাষ্ট্রচিন্তা অধ্যয়নের প্রয়োজন রয়েছে।


 

প্রশ্ন ॥ প্রাচ্যের-রাষ্টচিন্তার প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর ।


প্রাচ্য রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে ধর্ম ও নৈতিকতার সামঞ্জস্য থাকলেও প্রকৃতপক্ষে ততটা ধর্মকেন্দ্রিক নয়। কেননা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে ধর্ম ও রাষ্ট্রনীতিকে এক করে দেখা হয়নি। তাছাড়া মধ্যযুগে প্রাচ্যের মুসলিম চিন্তাবিদগণ প্লেটো ও এরিস্টটলের ধারণার সাথে মুসলিম দর্শনের সমন্বয় সাধন করেছেন। এক্ষেত্রে প্রাচ্য রাষ্ট্রচিন্তার বেশকিছু বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান।

প্রাচ্যের-রাষ্ট্রচিন্তার প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ : 

নিম্নে প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হলো :

১. আদর্শবাদ :

আদর্শবাদ প্রাচ্য রাষ্ট্রচিন্তার প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রাচ্যের চীনে কনফুসিয়াসের আদর্শকে কেন্দ্র করে আদর্শবাদ তত্ত্বের উদ্ভব ঘটে। তাছাড়া মধ্যযুগে ইসলামি ভাবধারার আদলে আদর্শবাদী ভাবধারা গড়ে উঠে।

২. নীতিবাদ:

প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা যতটা না রাজনৈতিক তার চেয়ে নৈতিক প্রকৃতির। প্রাচীন ভারতের ভানুসংহিতা, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, কনফুসিয়াস, লাওৎসের ভাবধারা এবং ইসলামের সকল কাজে নৈতিকতার উপদেশ বাণী পাওয়া যায়।


৩. অভিজ্ঞতাবাদ:

প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অভিজ্ঞতাবাদ। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার নিদর্শন পাওয়া যায়। কনফুসিয়াসের রাজনৈতিক চিন্তাধারা তার অভিজ্ঞতার ফসল। পরবর্তী রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণ রাষ্ট্রদর্শনের গবেষণায় অভিজ্ঞতাবাদকে কাজে লাগান। তাছাড়া উপনিষদ, মহাভারত, জাপানে মেইজি রেস্টোরেশনে অভিজ্ঞতাবাদের প্রভাব দৃশ্যমান ।

৪. ন্যায়বিচার :

প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো ন্যায়বিচার। প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণ তাদের গবেষণা, লেখনিতে ন্যায়বিচারের কথা উল্লেখ করেছেন। কনফুসিয়াসের রাষ্ট্রদর্শনের অন্যতম দিক ছিল ন্যায়বিচার। তিনি ন্যায়পরায়ণ রাজা ও রাজতন্ত্রকে লালন করার কথা বলেছেন। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও রাজাকে ন্যায়পরায়ণ হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর ইসলামের রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল দর্শন হলো ন্যায়বিচার।

৫. ধর্মের প্রাধান্য : 

প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার উপর ধর্মের প্রভাব কম নয়। কনফুসিয়াসের রাজনৈতিক চিন্তাধারা সমাজজীবনে ধর্মীয় নীতি হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। তাওবাদের দর্শন ও ধর্মকেন্দ্রিক চিন্তাধারার বিকাশ ঘটায়। মহাত্মা গান্ধীর সর্বোদয় আর সত্যাগ্রহ সবই ধর্ম উদ্ভূত চিন্তা। ইসলাম ধর্ম-রাষ্ট্রীয় জীবনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। মুসলিম শাসন ও চিন্তাবিদগণ ধর্মকেন্দ্রিক ভাবধারার উদ্ভব ঘটান। ৬. মানবতাবাদ প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তায় মানবতাবাদের নিদর্শন লক্ষ্য করা যায়। প্রাচ্যের দার্শনিক কনফুসীয় দর্শনে মানবতাবাদের উল্লেখ করা হয় । এখানে ব্যক্তির অধিকারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়। আধুনিক ভারতের রাষ্ট্রচিন্তাবিদ এম এন রায়ের দর্শনেও মানবতাবাদের প্রমাণ মেলে।

৭. সুশাসন : 

পাশ্চাত্যে রাষ্ট্রচিন্তাবিদদের লেখায় রাজতন্ত্রের স্বেচ্ছাচারিতার নজির পাওয়া যায়। কিন্তু প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তায় সুশাসনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কনফুসিয়াস রাষ্ট্রে সুশাসন নিশ্চিত করতে শাসককে নির্দেশ দিয়েছেন। মুসলিম শাসকগণ বিশেষ করে হযরত উমর (রা.)-এর সুশাসন রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে বিশেষ নমুনা বহন করে ।

৮. রক্ষণশীলতা : 

প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা রক্ষণশীলতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ। প্রাচ্যের সমাজব্যবস্থায় কনফুসিয়াস, মহাত্মা গান্ধী ও মধ্যযুগের মুসলিম শাসকদের দর্শন চিন্তা অপরিবর্তিত রয়েছে। 

৯. আন্তর্জাতিকতা : 

প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা আন্তর্জাতিকাবাদে বিশ্বাসী। ইসলামের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বৈদেশিক সম্পর্ক, এক রাষ্ট্রের সাথে অন্য রাষ্ট্রের সম্পর্ক, কূটনৈতিক তৎপরতা, পররাষ্ট্রনীতি আন্তর্জাতিকতাবাদের পরিচায়ক।



প্রশ্ন॥ প্রাচ্যের-রাষ্ট্রচিন্তার বিষয়বস্তু ও পরিধি আলোচনা কর। 


প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার বিষয়বস্তু খুবই ব্যাপক ও বিস্তৃত। আত্মপরিচিতি ও আত্মশক্তি থেকে শুরু করে পরলৌকিক মুক্তি তথা ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয় প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিভার অন্তর্ভুক্ত। এক কথায়, প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তাবিদদের চিন্তাধারার সকল আলোচনা প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার বিষয়বস্তু ।

প্রাচ্যের-রাষ্ট্রচিন্তার বিষয়বস্তু ও পরিধি : 

নিম্নে প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার বিষয়বস্তু ও পরিধি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো : 

১. ইসলামি জীবনব্যবস্থা : 

প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তায় ইসলামি জীবনব্যবস্থা সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা করা হয়েছে। ইসলাম কী, ইসলামের উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ, ভিত্তি, উৎস, আরকান, আহকাম, রোকনসহ সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, জাতীয় ও আন্ত জাতিক জীবনের যাবতীয় সমাধান প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার অন্তর্ভুক্ত।


২. ইসলামি আইন সম্পর্কে আলোচনা : 

ইসলামি আইন সম্পর্কে আলোচনা প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম বিষয়। ইসলামি আইনের সংজ্ঞা, উৎস, বৈশিষ্ট্য, ইসলামি আইন প্রণয়ন পদ্ধতি, আইন বাস্তবায়নের পদ্ধতি, ইসলামি আইন অমান্য করার শাস্তিসহ বিভিন্ন দিক প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার আওতাভুক্ত।


৩. ইসলামি অর্থব্যবস্থা : 

একটি সমাজকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে পারে শুধুমাত্র ইসলামি অর্থব্যবস্থা। ইসলামি অর্থ ব্যবস্থা কি?অর্থব্যবস্থার বিষয়বস্তু, পরিধি, বৈশিষ্ট্য, গুরুত্ব/প্রয়োজনীয়তা, উৎপাদন, বণ্টন, ইসলামি আয়ের উৎস, ব্যবসা-বাণিজ্য, লেনদেন, ব্যাংকিং এবং অন্যান্য অর্থব্যবস্থার সাথে সম্পর্ক বা পার্থক্যের বিষয় প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার পরিধিভুক্ত। 

৪. ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা : 

প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার জগতে বেশিরভাগ স্থান জুড়ে রয়েছে সামাজিক ন্যায়বিচার বা আদর্শ। ভারতের কৌটিল্য ও চীনের কনফুসিয়াস রাষ্ট্রীয় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য সুপারিশ করেন। তাছাড়া কুরআন ও হাদিসের আলোকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা প্রাচ্য রাষ্ট্রচিন্তার উল্লেখযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

৫. ইসলামি রাষ্ট্রচিন্তার মৌলিক ধারণা: 

ইসলামি রাষ্ট্রচিন্তার মৌলিক বিষয়সমূহ প্রাচ্য রাষ্ট্রচিন্তার পরিধিভুক্ত। আল্লাহর একত্ববাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, খেলাফত, ন্যায়বিচার, ইসলামি সভ্যতার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ প্রভৃতি বিষয় নিয়ে প্রাচ্য রাষ্ট্রচিন্তা আলোচনা করে থাকে।

৬. রাজনৈতিক ব্যবস্থা : 

প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার আলোচনায় ইসলামি রাজনৈতিক ব্যবস্থা স্থান পায়। ইসলামি রাষ্ট্রের গঠন, উপাদান, মূলনীতি, বৈশিষ্ট্য, ইসলামি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক অবস্থা, আইন, বিচার, শাসন বিভাগের গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলি, দায়িত্ব-কর্তব্য প্রভৃতি বিষয় প্রাচ্য রাষ্ট্রচিন্তার অন্তর্ভুক্ত।

৭. সামাজিক অবস্থা : 

সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, সামাজিক অনাচার, অবিচার, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, মাদকাসক্তিসহ নানাবিধ সামাজিক অপরাধসমূহ দূরীকরণে প্রাচ্য রাষ্ট্রচিন্তা আলোচনা করে থাকে 

৮. আদর্শবাদ : 

প্রাচীনে চীনের দার্শনিক কনফুসিয়াস ও ভারতের কৌটিল্যের আদর্শকে লালন করে প্রাচ্য রাষ্ট্রচিন্তা গড়ে মধ্যযুগে মুসলিম চিন্তাবিদদের নীতিদর্শন ও রাষ্ট্রদর্শন ইসলামি ভাবধারার আলোকে গড়ে উঠে। ফলে আদর্শবাদ প্রাচ্য রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম বিষয় হিসেবে পরিগণিত হয়। 

৯. যুদ্ধ, শাস্তি ও নিরাপত্তা : 

যুদ্ধ কেউ চায় না, সবাই শাস্তি চায়। একান্ত বাধ্য না হলে যুদ্ধে কেউ জড়ায় না। প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণ তাদের আদর্শ ও নীতি দ্বারা যুদ্ধ বর্জনের মত প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে ইসলামি আদর্শ ও ন্যায়ভিত্তিক ভাবাদর্শে যুদ্ধের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে সবাই শান্তি ও নিরাপত্তা চায়


প্রশ্ন॥ রাষ্ট্রচিন্তায় গ্রিকদের অবদান আলোচনা কর। অথবা, রাষ্ট্রচিন্তায় গ্রিকদের অবদান তুলে ধর।


বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতাসমূহের মধ্যে গ্রিক সভ্যতা শীর্ষস্থানীয়। এ সভ্যতায় যেসব মনীষীর আবির্ভাব ঘটেছে তাঁদের প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি পরবর্তীকালের পাশ্চাত্য সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করেছে বহুগুণে। স্বাধীনতা, সাম্য, গণতন্ত্র, নিয়মতান্ত্রিকতা, আইন সার্বভৌমত্ব প্রভৃতি সম্পর্কে গ্রিকরা যেসব তথ্য দিয়েছেন তা আজও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়। তাই বলা যায়, গ্রিকদের হাত ধরেই রাষ্ট্রচিন্তার উদ্ভব। 

রাষ্ট্রচিন্তায় গ্রিকদের অবদান:

১. রাষ্ট্র সম্পর্কে ধারণা : 

গ্রিকরাই সর্বপ্রথম রাষ্ট্রসম্পর্কিত ধারণার সূত্রপাত ঘটায়। তারাই রাষ্ট্রের উৎপত্তি, প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলোচনা করে, তাছাড়া রাষ্ট্রের কার্যাবলি সম্পর্কেও তারা আলোচনা করে। তাছাড়া রাষ্ট্র ও ব্যক্তির মধ্যে কেমন সম্পর্ক থাকবে সে সম্পর্কেও তারা মতামত প্রদান করেন।

২. স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র : 

গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তার একটি বিশেষ অবদান হলো স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র। গ্রিকদের মধ্যে রাজনৈতিক স্বাধীনতার যে স্পৃহা ছিল তা পূর্ববর্তী কোনো দেশে দেখা যায়নি। গণতন্ত্রের ক্রমবিকাশেও গ্রিকদের অবদান অত্যন্ত প্রশংসনীয়। রাষ্ট্রীয় কাজে সকল নাগরিকের অংশগ্রহণের ফলে তাদের সমাজব্যবস্থাও গণতান্ত্রিক চরিত্র লাভ করে। ৩. ব্যক্তি স্বাধীনতা : গ্রিকরাই সর্বপ্রথম ব্যক্তিস্বাধীনতার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে। এরিস্টটল বলেন যে, “মানুষ যদি তার পূর্ণতার চূড়ান্ত পর্যায়ে উন্নীত করতে হয়, তাহলে তাকে অবাধ স্বাধীনতা দিতে হবে। কারণ স্বাধীনতা কোনো ব্যক্তিসত্তা পরিপূর্ণভাবে বিকাশ লাভ করতে পারে না।

৪. আইনের প্রতি শ্রদ্ধা : 

আইনের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করা গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। তারাই সর্বপ্রথম আইন মানার গুরুত্ব অনুধাবন করে। তাঁদের মতে, আইন প্রকৃতির উৎস এবং মানব প্রজ্ঞা প্রকৃতির ইচ্ছে আবিষ্কারের উপায়। রাষ্ট্রের সকলে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবো।

৫. ন্যায়বিচার : 

সর্বপ্রথম গ্রিক রাষ্ট্রদর্শনেই ন্যায়বিচার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় এবং ন্যায়বিচারের গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়। গ্রিকদের মতে, যারা যা প্রাপ্য তাকে তা দেয়াই ন্যায়বিচার। তাদের মতে, যদি সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা না হয় তবে সমাজে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে। তাদের ন্যায়বিচার ধারণা আধুনিক ন্যায়বিচার ধারণার পথিকৃৎ ।

৬. নৈতিকতা : 

প্রাচীন গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তার গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য হলো রাষ্ট্রে নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করা। তারা আইন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় পুরাকথা, ধর্ম, নৈতিকতা প্রকৃতির উপর সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি তারা রাজনৈতিক কার্যাবলিতেও ধর্মের নিয়মনীতি অনুসরণের তাগিদ দিয়েছেন। তাদের এ অবদান বর্তমানেও আলোচনার বিষয়।

উপসংহার : 

পরিশেষে বলা যায়, গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তা হলো আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার পথিকৃৎ ও মূলভিত্তি। মূলত রাষ্ট্রচিন্তার উৎপত্তিই প্রাচীন গ্রিসের নগর রাষ্ট্রগুলোতে এ রাষ্ট্রচিন্তায় গ্রিকদের এতসব অবদান থাকা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত গ্রিসের নগর রাষ্ট্রগুলো সাম্রাজ্যবাদী চেতনায় মত্ত হয়ে উঠায় তাদের পতন ঘটে। এজন্য অনেক ঐতিহাসিক গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তাকে অমূর্ত আদর্শ বলে ব্যাখ্যা করেছেন।


নিত্য নতুন সকল আপডেটের জন্য জয়েন করুন

Telegram Group Join Now
Our Facebook Page Join Now
Class 8 Facebook Study Group Join Now
Class 7 Facebook Study Group Join Now
Class 6 Facebook Study Group Join Now

Post a Comment