শের শাহের শাসনব্যবস্থা এবং তার চরিত্র ও কৃতিত্ব

শের শাহের শাসনব্যবস্থা সংক্ষেপে আলোচনা কর।, শের শাহের চরিত্র ও কৃতিত্বের মূল্যায়ন কর। অথবা, শের শাহের চরিত্র ও কৃতিত্ব আলোচনা কর।
Follow Our Official Facebook Page For New Updates


Join our Telegram Channel!

প্রশ্ন : শের শাহের শাসনব্যবস্থা সংক্ষেপে আলোচনা কর। অথবা, শের শাহের শাসনব্যবস্থার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও। অথবা, শের শাহের শাসনব্যবস্থার একটি বিবরণ দাও। অথবা, শাসক হিসেবে শের শাহের কৃতিত্ব মূল্যায়ণ কর।


শের শাহের শাসনব্যবস্থা

উপস্থাপনা : 

শের শাহের শাসনকাল ছিল ক্ষণস্থায়ী; কিন্তু এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই তিনি শাসনকার্যে যে প্রতিভার পরিচয় প্রদান করেছিলেন তা সত্যিই আশ্চর্যজনক। 

ঐতিহাসিক কীন বলেন, কোনো সরকারই এমন কি ব্রিটিশ রাজও এ পাঠানের (শের শাহ) মতো এরূপ বুদ্ধিমত্তা প্রকাশ করতে পারেননি। 

শের শাহের শাসনব্যবস্থা:

১. কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা : 

রাজ্যে শাসনকার্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য শের শাহ তাঁর কেন্দ্রীয় প্রশাসনে ৪ জন মন্ত্রী ও ৪ জন পদস্থ অফিসার নিয়োগ করেন। 

ক. দিওয়ান-ই ওজারাত : দিওয়ান-ই ওজারাতের প্রধান ছিলেন উজীর। এ বিভাগের দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রের রাজস্ব ও আয় ব্যয় নির্ধারণ করা।

খ. দিওয়ান-ই আরজ : দিওয়ান ই আরজের প্রধান ছিলেন আরজ-ই মালিক। তিনি সেনাবাহিনীর বেতনভাতা, প্রশিক্ষণ, পদোন্নতি, বরখাস্ত, নিযুক্তি, বদলী ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করতেন। 

গ. দিওয়ান-ই রিসালাত : একজন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে ছিল দিওয়ান-ই রিসালাত। বৈদেশিক রাষ্ট্রদূতের সাথে যোগাযোগ, বৈদেশিক সম্পর্ক স্থাপন ও রাজকীয় দান খয়রাত পরিচালনা এ বিভাগের দায়িত্বে ছিল। 

ঘ. দিওয়ান-ই ইনশা: একজন মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিল দিওয়ান-ই ইনশা। প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের সাথে যোগাযোগ ও সরকারি রেকর্ড সংরক্ষণ এ বিভাগের দায়িত্বে ছিল। 

এছাড়াও কাজী-উল কুজাত, মীর-ই আতিশ, সদরুস সুদূর ও মুহতাসিব নামে আরো ৪ জন উচ্চপদস্থ কেন্দ্রীয় কর্মকর্তা ছিলেন। সমগ্র দেশের প্রশাসন ব্যবস্থা শের শাহ স্বয়ং পরিচালনা, পর্যালোচনা ও পরিদর্শন করতেন।

২. প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা : 

সুষ্ঠুভাবে শাসনব্যবস্থা পরিচালনার জন্য শের শাহ সমগ্র সাম্রাজ্যকে ৩৭টি সরকার এবং প্রত্যেক সরকারকে কতকগুলো পরগনায় বিভক্ত করেন। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, শের শাহের রাজ্যে ১,১৩,০০০ ফরগনা ছিল। 

গ্রাম ছিল ক্ষুদ্রতম প্রশাসনিক ইউনিট প্রত্যেক পরগনায় একজন শিকদার, আমীর, মুনসিফ বা খাজাঞ্চী ও দু'জন কেরানি ছিলেন। এছাড়া রাষ্ট্রের সাথে সংযোগ রক্ষার জন্য শের শাহ পাটওয়ারী, চৌধুরী ও মুকাদ্দাম নামক কর্মচারিদেরও নিয়োগ করেন।

৩. রাজস্ব ব্যবস্থা : 

শের শাহের রাজত্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি ছিল রাজস্ব ব্যবস্থা। শের শাহ নির্ভুলভাবে জমি জরিপ ব্যবস্থা চালু করে জমির উৎপাদিকা শক্তির অনুপাতে প্রজাদের সঙ্গে সরাসরি খাজনা আদায়ের ব্যবস্থা করেন। 

উৎপন্ন ফসলের এক চতুর্থাংশ রাজস্ব হিসেবে নির্ধারণ করা হতো। জনগণ সরাসরি নগদ অর্থ অথবা উৎপাদিত ফসল দ্বারাই খাজনা পরিশোধ করতে পারতো।

 খাজনা আদায়ের জন্য তিনি মুকাদ্দাম, চৌধুরী, পাটোয়ারী, কানুন গো প্রমুখ কর্মচারীদের সাহায্য নিতেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় রাজস্ব মওকুফ করা এবং ঋণ দেয়া ছিল এ বিভাগের দায়িত্ব।

৪. শিক্ষা সংস্কার : 

শের শাহ শিক্ষার একজন একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। শিক্ষার উন্নতিকল্পে তিনি বহু স্কুল ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

৫. বিচার ব্যবস্থা : 

সুবিচারক ও ন্যায়পরায়ণ হিসেবে শের শাহের সুনাম সর্বজন স্বীকৃত। শের শাহ ছিলেন সর্বোচ্চ বিচারপতি। পরগনায় আমীন দেওয়ানী মামলার এবং কাজী ও মীর আদল ফৌজদারী ও অন্যান্য মোকদ্দমার বিচার করতেন। 

৬. সামরিক ব্যবস্থা :

 শের শাহ জায়গীর প্রথা বাতিল করে বেতনভোগী সৈন্য পোষণ করতেন। সেনাবাহিনীতে দাগ এবং চেরা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। সৈন্য বাহিনীতে তিনি নিয়ম শৃঙ্খলার প্রবর্তন করেন। 

৭. যোগাযোগ ব্যবস্থা : 

সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে সুষ্ঠু যোগাযোগ ব্যবস্থা রক্ষার জন্যশের শাহ বহু প্রশস্ত, সুন্দর ও দীর্ঘ রাস্তা তৈরি করেন। এসব সড়কের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সুন্দর, দীর্ঘ ও প্রশস্ত ছিল গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড। 

ঈশ্বরীপ্রসাদ বলেন, শের শাহ সর্বপ্রথম মুসলিম নৃপতি যিনি জনগণের সুবিধার্থে অসংখ্য রাস্তা নির্মাণ করেন। 

৮. ধর্মীয় নীতি : 

একজন নিষ্ঠাবান মুসলমান হয়েও শের শাহ অন্য ধর্মের প্রতি সহনশীল ও উদার মনোভাব পোষণ করতেন। তাঁর ধর্মীয় নীতিতে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায় সন্তুষ্ট ছিল।

৯. পুলিশ ও গুপ্তচর প্রথা : 

যাতায়াত ও ব্যবসা বাণিজ্যের নিরাপত্তা এবং অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য শের শাহ একটি সুদক্ষ ও শক্তিশালী পুলিশ বাহিনী গঠন করেছিলেন। শের শাহ সমগ্র রাজ্যে গুপ্তচর ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। 

১০. বদলির ব্যবস্থা : 

ঐতিহাসিক ঈশ্বরীপ্রসাদ বলেন, শাসনকার্য নিরপেক্ষভাবে পরিচালনা ও শাসকবর্গের স্থানীয় প্রভাব খর্ব করার জন্য শের শাহ দুই বা তিন বছর পর পর তাদের একস্থান হতে অন্যস্থানে বদলির ব্যবস্থা করেন। প্রয়োজন না হলে শের শাহ স্থানীয় প্রশাসন কার্যে হস্তক্ষেপ করতেন না । 

১১. ঘোড়ার ডাকের প্রবর্তন : 

শের শাহের আর একটি জনহিতকর কার্য হলো তিনি ঘোড়ার ডাকের প্রতিষ্ঠা করে যোগাযোগের যথেষ্ট উন্নতি সাধন করেছিলেন। 

১২. কবুলিয়ত ও পাট্টা প্রথা চালু করা :

শের শাহ রাজ্যে কবুলিয়ত ও পাট্টা ব্যবস্থা চালু করেন। কৃষকগণ তাদের দায়িত্ব ও অধিকার বর্ণনা করে সরকারকে যে অঙ্গীকারনামা প্রদান করতো তা কবুলিয়ত এবং 

সরকার জমির ওপর কৃষকদের স্বত্ব স্বীকার করে যে দলীল দিত তা পাট্টা নামে পরিচিত ছিল। এ ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে অতিরিক্ত কর প্রথার বিলোপ এবং জমিদারি প্রথার বিলোপ ঘটে।

১৩. মুদ্রানীতি সংস্কার : 

শের শাহ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে মুদ্রানীতির সংস্কার সাধন করেন। তিনি প্রচলিত জাল ও বিভিন্ন মানের মুদ্রা বাতিল করে রৌপ্য মুদ্রার প্রচলন করেন। যা পরবর্তীতে তংকা ও রূপাইয়া নামে পরিচিতি লাভ করে।

তিনি সোনা এবং তাম্র মুদ্রারও চালু করেন। তিনি আধুলি, সিকি, দুআনি ও এক আনি ইত্যাদি খুচরা মুদ্রারও প্রবর্তন করেন। তাঁর মুদ্রানীতি সংস্কারের ফলে তৎকালে ব্যবসায় বাণিজ্যে ব্যাপক প্রসার ঘটে। 

১৪. জনগণের নৈতিক চরিত্র উন্নয়ন : 

জনগণের নৈতিকমান উন্নয়নের জন্য শের শাহ একজন মুহতাসিব নিয়োগ করেন। তিনি ধর্মীয় আইন কানুন প্রয়োগ ও অপরাধীকে শাস্তি প্রদান করতেন।

১৫. গুপ্তচর প্রথা চালু : 

গিয়াসউদ্দিন বলবন ও আলাউদ্দিন খলজীর অনুসরণে শের শাহও তাঁর সাম্রাজ্যে গুপ্তচর প্রথা চালু করেন। গুপ্তচরের মাধ্যমে তিনি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সংঘটিত ঘটনাসমূহের খবর নিতেন এবং

জরুরিভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন। ফলে তাঁর সময়ে চুরি ডাকাতি হ্রাস পায় এবং সর্বত্র শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় থাকে।

১৬. স্থাপত্যশিল্প : 

শের শাহ অনেকগুলো সুউচ্চ অট্টালিকা নির্মাণ করেন। রোটার্স দুর্গ, দিল্লির পুরানা কেল্লা এবং সাসারামে নির্মিত সমাধি সৌধ তাঁর সুন্দর শিল্পী মনের পরিচয় বহন করে। 

১৭. শুল্ক ও মুদ্রানীতি : 

শের শাহ সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির জন্য সুচিন্তিত ও জনমঙ্গলকর শুষ্ক ও মুদ্রানীতি চালু করেন। তিনি স্বর্ণমুদ্রাসহ আধুলি, সিকি, দুআনি ও এক আনি খুচরা মুদ্রার প্রবর্তন করেন। 

১৮. সরাইখানা নির্মাণ : 

শের শাহ পথিকদের খাওয়া ও রাতযাপনের সুবিধার্থে হিন্দু ও মুসলিমদের জন্য পৃথক পৃথক সরাইখানা তৈরি করেছিলেন। জানা যায় যে, শের শাহ সতেরো শত সরাইখানা নির্মাণ করেছিলেন। 

উপসংহার : 

পরিশেষে বলা যায়, ধূমকেতুর মতো ভারতের রাজনৈতিক মঞ্চে আবির্ভূত হয়ে শের শাহ যে প্রশাসনিক সংস্কার সাধন করেন, তার তুলনা ইতিহাসে বিরল। 

ঐতিহাসিক স্মীথ বলেন, শের শাহ যদি অধিককাল রাজত্ব করার সুযোগ পেতেন তাহলে ইতিহাসে মহান মুঘলদের আবির্ভাব ঘটতো না। 

ঐতিহাসিক হেগের সাথে একমত হয়ে বলা যায় যে, শাসক হিসেবে শের শাহ ছিলেন দিল্লির সিংহাসনে আরোহণকারীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ।



প্রশ্ন : শের শাহের চরিত্র ও কৃতিত্বের মূল্যায়ন কর। অথবা, শের শাহের চরিত্র ও কৃতিত্ব আলোচনা কর।

উপস্থাপনা : 

মুসলিম শাসনের ইতিহাসে যে সকল শাসক সুশাসনের জন্য অমর হয়ে আছেন শূর সম্রাট শের শাহ তাঁদের অন্যতম। 

দূরদর্শিতা, অক্লান্ত কর্মনিষ্ঠা, প্রজাহিতৈষী, সর্বোপরি প্রজাবর্গের প্রতি পিতৃতুল্য দায়িত্ববোধের জন্য শের শাহ মধ্যযুগীয় ভারতের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ শাসকদের অন্যতম হিসেবে শ্রদ্ধার উচ্চ আসন অধিকার করে আছেন। 

শের শাহের উচ্চসিত প্রশংসা করে ঐতিহাসিক বীনি বলেন- No government not even the British has shown so much wisdom as this Pathan (Sher Shah).

শের শাহের চরিত্র:

১. ধর্মপরায়ণ : 

শের শাহ সর্বদা আল্লাহর ওপর আস্থা রাখতেন। কথিত আছে, তিনি প্রতিদিন প্রত্যুষে শয্যা ত্যাগ করতেন। তারপর গোসল করে সালাত আদায় করতেন। কখনো তিনি নামায তরক করতেন না। 

সন্ধ্যায় কিছু সময় তিনি কুরআন অধ্যয়ন করতেন। নিজ জীবনের সাফল্যকে তিনি আল্লাহর মেহেরবানী বলে গ্রহণ করতেন।

২. হৃদয়বান : 

মহানুভবতা, উদারতা, পরোপকারের মনোভঙ্গি শের শাহের চরিত্রকে মহিমান্বিত করে তুলেছিল। দুস্থদের ভাতা, ছাত্রদের বৃত্তি এবং দ্বীন প্রচারক মুবাল্লিগদের তিনি বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা ও ভাতা প্রদান করতেন।

গরিব দুঃখীদের প্রতি তিনি অত্যন্ত দয়ালু ছিলেন এবং তাদের জন্য তাঁর খাবারগৃহ সর্বদা উন্মুক্ত থাকত। কথিত আছে যে, গভীর রাতেও কোনো গরিব দুঃখীকে খালি হাতে ফিরিয়ে না দেয়ার জন্য রাজকীয় অধ্যক্ষের প্রতি তাঁর কড়া নির্দেশ ছিল। 

শের শাহ যুদ্ধের সময়ও উদারতা প্রদর্শন করতেন। তিনিসৈন্যদেরকে নিরীহ লোকদের ওপর অত্যাচার ও লুণ্ঠন করতে দিতেন না । 

৩. কর্তব্যনিষ্ঠা : 

শের শাহ কর্তব্যনিষ্ঠা ও কর্তব্যপরায়ণ। কর্মনিষ্ঠা, শ্রমনিষ্ঠা ও অধ্যবসায়ের চমৎকার সংমিশ্রণ তাঁর চরিত্রে দেখতে পাওয়া যায়। কর্তব্যপালনে তিনি একনিষ্ঠ ছিলেন। 

জনগণের কল্যাণে তিনি কঠোর পরিশ্রম করতেন। তাঁর অনবদ্য প্রচেষ্টার বদৌলতেই সাম্রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয় ।

৪. বলিষ্ঠ সাহসী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী : 

শের শাহ ছিলেন বলিষ্ঠ সাহসী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী তাঁর চরিত্রে অনন্যসাধারণ বহুমুখী সুললিত গুণের সমাবেশ ঘটেছিল। তিনি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। 

তিনি ধূমকেতুর ন্যায় ভারতের রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশে উদিত হন। সামান্য জায়গিরদারের পুত্র হয়েও স্বীয় উদ্যম, সৎসাহস ও বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা, ধৈর্য কর্মনিপুণতা ও অধ্যবসায়ের দ্বারা তিনি এক বিশাল সাম্রাজ্যের ভাগ্যবিধাতা হতে পেরেছিলেন।

৫. সর্বজনীন : 

শের শাহ অহংকারকে ঘৃণা করতেন। রাজ্যের যে কেউ দরবারে তাঁর সাথে নির্বিবাদে কথা বলতে পারতেন। তিনি আন্তরিকতা ও ধৈর্যের সাথে জনসাধারণের অভাব অভিযোগের কথা শুনতেন।

শের শাহের কৃতিত্বসমূহ:

১. সমরবিদ হিসেবে শের শাহ : 

শের শাহ ছিলেন একজন অসাধারণ সুদক্ষ সমরবিদ। তিনি অনন্য সাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন দক্ষ সামরিক প্রশাসক ছিলেন। রণচাতুর্য ও ব্যূহ রচনা কলাকৌশলে মুঘল অধিপতিগণ তাঁর সমকক্ষ ছিলেন না। 

মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বিগ্রহে তিনি অসাধারণ বীরত্ব ও সমর নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন। চৌসা ও কনৌজের যুদ্ধে সফলতা লাভ তাঁর সামরিক দক্ষতারই যথার্থ প্রমাণ। 

তাঁর নিপুণ যুদ্ধ পরিকল্পনা ও সেনা পরিচালনায় যথেষ্ট মৌলিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি সমরকুশলী হিসেবে ইতিহাসে সমধিক প্রসিদ্ধ। বিশ্বের সর্বাপেক্ষা চৌকস সমরবিশারদগণের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম ।

২. প্রজ্ঞাবান রাজনীতিবিদ : 

প্রজ্ঞাবান রাজনীতিবিদ হিসেবেও শের শাহ ছিলেন অতুলনীয়। তিনি রাজনীতির ক্ষেত্রে উদারতার নীতি অবলম্বন করেন এবং জনমতের ওপর ভিত্তি করে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেন। 

ঐতিহাসিক ক্রক শের শাহের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।

৩. সুদক্ষ প্রশাসক : 

দক্ষ প্রশাসক হিসেবে শের শাহ সবিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। সাম্রাজ্যের শাসন ব্যবস্থাকে সুষ্ঠু, সুদৃঢ় ও জনহিতকর করে তোলাই ছিল শের শাহের শাসন নীতির মূখ্য উদ্দেশ্য। 

সমাজের উন্নতির দিকে তাঁর প্রখর দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল এবং তিনি সর্বদা প্রজাসাধারণের হিত ও মঙ্গল চিন্তা করতেন। তিনি দেশ শাসনের ব্যাপারে সর্বদা মনোযোগী ছিলেন এবং 

শাসনকার্যে প্রত্যেক বিভাগের খুঁটিনাটি বিষয়ও তাঁর দৃষ্টি এড়াতো না।তিনি দুর্নীতিকে ঘৃণা করতেন এবং অন্যায় অপকর্মকে বরদাশত করতেন না।

৪. উন্নত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন : 

শের শাহ প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ভারতের নীতিনিষ্ঠ শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন এবং স্বীয় প্রতিভা ও উদ্ভাবনী শক্তির সাহায্যে এক উন্নত প্রশাসন ও অভিনব যুক্তিসঙ্গত প্রশাসন গড়ে তোলেন। তাঁর সংস্কার পদক্ষেপ মুঘল সম্রাট আকবরকেও প্রভাবিত করে। 

শের শাহের ভূমি রাজস্ব নীতি অনেকাংশে আকবর গ্রহণ করেন। শের শাহের জনহিতৈষী শাসননীতির দ্বারাও আকবর বহুলাংশে প্রভাবিত হন। ঐতিহাসিকগণ একবাক্যে স্বীকার করেন, শের শাহই ভারত উপমহাদেশের রাজনৈতিক প্রশাসনের প্রতিষ্ঠাতা।

৫. জনকল্যাণমুখী শাসক : 

জনকল্যাণমুখী শাসক হিসেবে শের শাহের অবদান অনবদ্য। জনহিতৈষী মনোভাব তাঁর প্রশাসনিক কার্যক্রমকে অমরত্ব দান করে। ব্যাপক জনগণের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য তিনি শিল্প বাণিজ্য চারুকারু ও স্থাপত্য শিল্পেও যথেষ্ট উৎসাহ দান করেন। 

আন্তঃপ্রাদেশিক শুল্ক প্রত্যাহার, অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে উৎসাহদান, আইন ও বিচার ব্যবস্থার আধুনিকায়ন, জনকল্যাণমুখী কার্যক্রম, ঘোড়ার ডাক প্রবর্তন, বহু রাস্তা ঘাট ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদি তাঁর জনহিতৈষী মনোভঙ্গির পরিচয় দেয়।

৬. উন্নত দেশ ও জাতি সংগঠক: 

উন্নত দেশ, রাষ্ট্র গঠনের পাশাপাশি শের শাহ জাতি গঠনের পদক্ষেপও গ্রহণ করেন। তিনিই সর্বপ্রথম বিভিন্ন জাতিসত্তা, ধর্ম ও মতাদর্শ নির্বিশেষে জনগণকে নিয়ে একটি রাজনৈতিক জাতি গঠনের প্রয়াস এবং জাতি গঠনের প্রাথমিক কার্যক্রম সম্পাদন করতে সক্ষম হন। আকবরের সময় তা পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয় ।

৭. সুশীল সমাজ ও স্থাপত্য শিল্পানুরাগী : 

শের শাহ বিদ্বান ও পণ্ডিতদের শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। স্থাপত্য শিল্পের ইতিহাসেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ১৫৪২ খ্রিস্টাব্দে শূরী স্থাপত্যের ঐতিহ্য বহনকারী কিল্লা-ই কুহনা মসজিদ শের শাহ কর্তৃক নির্মিত হয়। 

দিল্লিতে প্রতিষ্ঠিত শূরী রাজধানী, পুরানা কিল্লা ও সাসারামে হ্রদের ধারে তাঁর সমাধিসৌধ তৎকালীন শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শন। শের শাহ নিজে বিদ্বান ছিলেন এবং তাঁর স্মৃতিশক্তি প্রখর ছিল। 

সিকান্দার নামা, গুলিস্তাঁ, বুস্তা প্রভৃতি গ্রন্থ তাঁর আদ্যপান্ত কণ্ঠস্থ ছিল। এমনি চিন্তা চেতনার মাধ্যমে তিনি একটি সুশীল সমাজ প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট ছিলেন

৮. ইসলামী আদব আখলাক :

কুরআন সুন্নাহভিত্তিক ইসলামের নীতি অনুযায়ী তিনি অমুসলিমদের প্রতি উদারতা ও সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করেন। চাকরি ক্ষেত্রে যোগ্যতা ও 

অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে শের শাহ হিন্দুদেরকে নিয়োগ করতেন। তিনি গোয়েন্দা বিভাগ ও রাজ্য বিভাগেও বহু হিন্দু কর্মচারী নিয়োগ করেন।

উপসংহার : 

উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে বলা যায়, চরিত্র ও কৃতিত্বের বিচারে ইতিহাসে শের শাহ এক উচ্চস্থান অধিকার করতে সক্ষম হন। 

মধ্যযুগীয় ভারতের ইতিহাসে তাঁর মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, ন্যায়পরায়ণ, প্রজাহিতৈষী, সুশাসক, সুদক্ষ সেনাপতি ও দূরদর্শী রাজনীতিবিদ অত্যন্ত বিরল। ড. ঈশ্বরী প্রসাদ যথার্থই বলেন, ইতিহাসে শের শাহ অনন্য মর্যাদার আসন লাভের যোগ্য।”

ঐতিহাসিক স্মিথ বলেন, শের শাহ যদি আরো কিছুকাল বেঁচে থাকতেন তাহলে মুঘল সম্রাটদের আর অভ্যুদয় ঘটতো না।”


নিত্য নতুন সকল আপডেটের জন্য জয়েন করুন

Telegram Group Join Now
Our Facebook Page Join Now
Class 8 Facebook Study Group Join Now
Class 7 Facebook Study Group Join Now
Class 6 Facebook Study Group Join Now

Post a Comment