বাংলায় কররানী বংশের উত্থান ও পতনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

বাংলায় কররানী বংশের উত্থান ও পতনের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও। [ফা. স্নাতক প. ২০১১, '১৪], বাংলায় কররানী বংশের উত্থান ও পতনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
Follow Our Official Facebook Page For New Updates


Join our Telegram Channel!

প্রশ্ন : বাংলায় কররানী বংশের উত্থান ও পতনের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও। [ফা. স্নাতক প. ২০১১, '১৪]

কররানী বংশের

উপস্থাপনা : 

বাংলায় আফগানদের শাসন ইতিহাসে কররানী বংশের শাসনামল একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। আফগান নেতা তাজখান কররানী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এ বংশের মোট চারজন শাসক ১৫৬৪-১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কররানী শাসন অব্যাহত রাখে।

শের শাহের পর আফগানদের মধ্যে কররানী বংশই বাংলার শাসন ইতিহাসে বিশেষ কৃতিত্বের দাবিদার। নিম্নে কররানী বংশের উত্থান ও পতন সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত বিবরণী পেশ করা হলো।

কররানী বংশের পরিচয় : 

কররানীরা আফগান অথবা পাঠান জাতিগোষ্ঠীর একটি শাখা বিশেষ। শের শাহ ও তাঁর পুত্র ইসলাম শাহ কর্তৃক আফগান গোত্র বওজীপুর রাজ্য ও খাওয়াসপুর তানডার পার্শ্ববর্তী এলাকা লাভ করলে তারা অদ্ভূতভাবে একটি বংশের সূচনা করে। 

কররানীদের আদি বাসস্থান ছিল বাঙ্গাশে। বর্তমানে এটা ‘কুররম' নামে পরিচিত। তাজ কররানীই এ বংশকে সর্বপ্রথম বঙ্গদেশে প্রসিদ্ধির পর্যায়ে উত্তরণ ঘটান ।

কররানী বংশের উত্থান : 

তাজখান কররানী এ বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। প্রথম জীবনে তাজখান শের শাহের একজন কর্মচারী ছিলেন। ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে আফগান দলপতি তাজখান ও তাঁর ভাই সুলায়মান খান কনৌজের যুদ্ধে শের শাহের বিরুদ্ধে হুমায়ুনের পক্ষে অসীম বীরত্ব প্রদর্শন করেন। 

এর ফলশ্রুতিতে হুমায়ুন তাজখান ও সুলায়মান খানকে বাংলা ও উত্তর বিহারের জায়গির প্রদান করেন। 

তাজখান পরবর্তীতে সুলতান শূর বংশের ইসলাম শাহের শাসনামলের বিশ্বস্ত অনুচর ছিলেন এবং সুলায়মান খান বিহারের গভর্নর নিযুক্ত হন। 

ইসলাম শাহের মৃত্যুর পর আদিল শাহ দিল্লির সিংহাসনে বসেন, কিন্তু তাঁর সাথে তাজখানের বিরোধ বাঁধে। ফলে তাজখান দিল্লির সরকার ত্যাগ করে সংগ্রামে লিপ্ত হন। 

কিন্তু যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বাংলা ও বিহারের দিকে চলে যান। সেখানে তাঁর ভাই সংঘবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। 

পাঠান কররানী বংশ প্রথমে শূর বংশীয় শাসকদের সাথে অস্ত্রধারণ করেন। কিন্তু কররানী বংশ এবং শূর বংশ উভয়েই আফগান গোষ্ঠী হওয়ায় তাদের মধ্যে সমঝোতা হয়। 

গিয়াসউদ্দিন নামক এক দখলকারী শূর সুলতান গিয়াসউদ্দিন জালাল শাহের ছেলেকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করেন। 

তাজখান জোর দখলকারীকে হত্যা করে গৌড়ের সিংহাসন দখল করেন, গৌড়ে তাজখান বেশিদিন রাজত্ব করতে পারেননি। তিনি ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন । 

সুলায়মান কররানী (১৫৬৫-৭২ খ্রি.)

কররানী বংশের শাসকদের মধ্যে সুলায়মান কররানী দীর্ঘকাল শাসন ক্ষমতায় ছিলেন। জে. এল. সরকারের ভাষায়— The term of Sulayman was longer than others of Karrani ruler in Bengal. নিম্নে সুলায়মান কররানীর শাসনামলের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হলো 

১. ক্ষমতা গ্রহণ : 

কররানী বংশের প্রতিষ্ঠাতা তাজখান কররানী ইন্তেকাল করলে তাঁর ভাই সুলায়মান কররানী বাংলার মসনদে সমাসীন হন। 

ইতঃপূর্বে তিনি বিহারের শাসক ছিলেন বিধায় বাংলা ও বিহারে সহজেই স্বীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন। তিনি অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। 

২. মুঘল নীতি : 

একজন দূরদর্শী শাসক হিসেবে তিনি বুঝতে পারেন যে, শক্তিশালী মুঘলদের সাথে সুসম্পর্ক ব্যতীত ক্ষমতা সুসংহত করা সম্ভবপর নয়। তাই তিনি মুঘলদের সাথে মিত্রতার নীতি গ্রহণ করেন। তিনি আকবরের দরবারে উপঢৌকন প্রেরণ করেন। 

তিনি নিজেকে সুলতান হিসেবে ঘোষণা করেননি; বরং হযরত আলী উপাধি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকেন। আকবরনামায় উল্লেখ আছে, তিনি সম্রাট আকবরের নামে খোতবা পাঠ করেন।

৩. অভ্যন্তরীণ শান্তি ও ইসলামী অনুশাসন: 

সুলায়মান কররানী বাংলার অধিপতি হয়ে নিজ রাজ্যে শান্তি স্থাপন করেন। ফলে তাঁর রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং ন্যায় বিচারক হিসেবে প্রসিদ্ধি অর্জন করেন। 

মুসলিম আলেম ওলামা ও দরবেশদের তিনি সবিশেষ শ্রদ্ধা করতেন। তিনি স্বীয় রাজ্যে কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক বিধি বিধান কার্যকরী করেন।

৪. উড়িষ্যা বিজয় : 

১৫৬৭ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম উড়িষ্যায় মুসলিম আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব দাবি করেন সুলায়মান কররানী। উড়িষ্যার রাজা মুকুন্দ হরিচরণ পলাতক ইবরাহীম খান শূরকে স্বরাজ্যে আশ্রয় দিলে সুলায়মানের সঙ্গে তাঁর বিরোধ সৃষ্টি হয়। 

সুলায়মানের ধারণা হয় উড়িষ্যার রাজা ইবরাহীম শুরকে তাঁর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করেছে। আকবর চিতোর বিজয়ে ব্যস্ত থাকার সুযোগে সুলায়মান তাঁর পুত্র বায়েজীদ এবং 

কালা পাহাড় নামে একজন ধর্মান্তরিত মুসলিম সেনাপতিকে এক বিশাল বাহিনীসহ উড়িষ্যায় প্রেরণ করেন।

৫. কুচবিহার জয় : 

উড়িষ্যা বিজয়ের পর সুলায়মান কররানী কুচবিহারের দিকে অভিযান প্রেরণ করেন। এ সময় কুচবিহারের শাসক ছিলেন বিশ্বসিংহ। তিনি কামতাপুর জয় করেন এবং কামতেশ্বর উপাধি লাভ করেন। 

পরবর্তীতে সুলায়মান কালা পাহাড়ের নেতৃত্বে তিনি যে বাহিনী পাঠান তা ব্ৰহ্মপুত্ৰ নদ অতিক্রম করে তেজপুর পর্যন্ত অগ্রসর হয়।

৬. কৃতিত্ব : 

সুলায়মান কররানী দূরদৃষ্টিসম্পন্ন শাসক ছিলেন। লোদী খান নামে তার যে উযীর ছিলেন তিনিই সুষ্ঠুভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। সেনাবাহিনীতে অসামান্য কৃতিত্বের জন্য কালা পাহাড় খ্যাতি অর্জন করেন। 

সুলায়মান কররানীর আমলে চট্টগ্রামের বাঁশখালী অঞ্চলে প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে ধারণা করা হয়, তিনি দক্ষিণ চট্টগ্রামসহ বাংলা ও বিহারের অধীশ্বর ছিলেন।

বায়েজীদ কররানী : 

সুলায়মান কররানীর মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র বায়েজীদ কররানী সিংহাসনে আরোহণ করেন। বায়েজীদ তাঁর ঔদ্ধত্য ও অত্যাচারের দ্বারা অল্প সময়ের মধ্যেই আফগান অভিজাতদের শত্রুতে পরিণত হন। 

ফলে সুলায়মান কররানীর ভাগ্নে ও জামাতা হানুস বায়েজীদের বিরুদ্ধে এক গোপন ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে চিহ্নিত হন এবং শেষ পর্যন্ত বায়েজীদ এসব শত্রুদের হাতেই নিহত হন।

দাউদ খান কররানী

বায়েজীদের মৃত্যুর পর দাউদ খান কররানী বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি উচ্চাভিলাষী, স্বাধীনচেতা ও তুখোড় শাসক ছিলেন। তিনি নিজ নামে মুদ্রা ছাপান এবং খোতবা পাঠের ব্যবস্থা করেন।

১. মুঘলদের সাথে সংঘর্ষ : 

শের শাহের আমলে পাঠান ও মুঘল সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধের সূত্রপাত হয়। আফগানবাসী পাঠান মধ্য এশিয়া থেকে উদ্ভূত মুঘলদের সাথে শৌর্য বীর্যে পেরে উঠতো না এবং শূরী ও কররানী আমলেই উভয়ের মধ্যেই বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। 

যদিও কররানী বংশের শাসকরা আকবরের বশ্যতা স্বীকার করেন, তবুও পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত পাঠান রাজ্য মুঘল রাজত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ ছিল। সুতরাং বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা বিজয় মুঘলদের জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়ে। 

এছাড়া আকবর নিজেকে ভারতের অধীশ্বর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করেন এবং এ অবস্থায় ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলে বিহার, উড়িষ্যা ও বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল,

 তার সাম্রাজ্যের বহির্ভূত থাকবে এটা চিন্তা করা যায় না। কিন্তু স্বাধীনচেতা দাউদ কররানী আকবরের এ সম্প্রসারণ নীতিতে বাধা দেন।

২. রাজমহলের যুদ্ধ : 

সম্রাট আকবর গুজরাটে ব্যস্ত থাকার কারণে সেনাপতি মুনিম খানকে দাউদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। মুনিম খান চুনার থেকে পাটনার দিকে অগ্রসর হলে দাউদের মন্ত্রী লোদী খান সেনাপতি গুজর খানের সহযোগিতায়,

মুঘল সেনাপতিকে প্রচুর উপহার সামগ্রী প্রদান করে মুঘল অভিযানকে বিলম্বিত করেন। ১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দে ক্ষমতা গ্রহণের পর দাউদ খান কালা পাহাড়ের সহায়তায় জৌনপুর পর্যন্ত স্বীয় রাজ্য বিস্তৃত করেন। 

দাউদ খান উযীর খান লোদী, কত লোহানী, গুজর খান ও শ্রীহরির সাথে একত্রিত হয়ে বিশাল বাহিনী গঠন করে মুঘল বাহিনীকে প্রতিরোধ করেন । 

৩. কটকের সন্ধি : দাউদ খান মুঘল বাহিনীকে প্রতিহত করলে কটকে আফগান ও মুঘল বাহিনীর মধ্যে এক সন্ধি স্থাপিত হয়। লোদী খান মুনিম খানকে নগদ দু'লক্ষ টাকা এবং একলক্ষ টাকার জিনিসপত্র প্রদানের অঙ্গীকার করেন। 

ইতোমধ্যে লোদী খান দাউদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করলে তাকে হত্যা করা হয়। ফলে তার সেনাবাহিনী দুর্বল হয়ে পড়ে।

৪. পুনরায় মুঘল আক্রমণ : 

লোদী খানের হত্যার পর আফগান বাহিনীতে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এ সুযোগে মুনিম খান পুনরায় বিশাল বাহিনীসহ শোন নদী পার হয়ে পাটনার দিকে অভিযান করেন। 

১৫৭৩ সালে পার্টনা অবরোধ বহুদিন চলে এবং কোনো রকম সফলতা অর্জন না হওয়ায় আকবর স্বয়ং ১৫৭৪ সালে পাটনায় পৌছেন। তিনি জৌনপুর ও পাটনা জয় করেন। 

দাউদ খান পাটনা ত্যাগ করে নিরাপদ আশ্রয়গ্রহণ করে তাঁর ঘাঁটি স্থাপন করেন। 

কিন্তু মুনিম খান ও টোডরমলের সম্মিলিত বাহিনী দাউদ খানকে বিতাড়িত করে তেলিয়াগড় দুর্গ দখল করেন। পরে তাণ্ডা মুঘলদের অধিকারে আসে। এরপর মুঘল বাহিনী দাউদের বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণ করে।

৫. দাউদের পরাজয় ও মৃত্যু : 

দীর্ঘকাল যাবৎ মুঘল-আফগান দ্বন্দ্ব অব্যাহত থাকার কারণে দাউদের মোকাবেলা করার জন্য খান জাহানকে সেনাপতি নিয়োগ করা হয়। 

তিনি ১৫৭৫ সালে বাংলায় অভিযান প্রেরণ করেন। তিনি বীর বিক্রমে মুঘল বাহিনীকে প্রতিরোধ করেন। 

তেলিয়াগড় দখল করে তিনি প্রথমে রাজমহলের দিকে অগ্রসর হন। দাউদ তার প্রতিরোধ করলে রাজমহলে ১৫৭৬ সালে পুনরায় যুদ্ধ শুরু হয়। দাউদের শক্তি ক্রমাগত বৃদ্ধি পেলে সম্রাট আকবর খান জাহানের সাহায্যে, 

বিহারের সেনাপতি মুজাফ্ফর খানকে পাঠান চক্রান্ত করে দাউদের দুজন সেনাপতিকে মুঘলরা নিজেদের দলে নেন। ফলে দাউদের ক্ষমতা হ্রাস পায়। 

রাজমহলের যুদ্ধে দাউদ খান পরাজিত ও নিহত হন। আর এর মধ্যদিয়ে বাংলায় কররানি বংশের পতন ঘটে।

উপসংহার : 

উপরিউক্ত আলোচনার আলোকে বলা যায়, কররানী বংশের স্বল্পকালীন শাসন প্রতিষ্ঠা বাংলার ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। 

তাদের শাসনামলে বাংলার রাজনৈতিক প্রতিপত্তি ও সীমারেখা যেরূপ বৃদ্ধি পেয়েছিল, সেরূপ আর কখনো হয়নি। 

দাউদ খান কররানীর শাসনামলে সমগ্র বাংলা এক অখণ্ড রাজশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। দাউদ খান শক্তিশালী মুঘলদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে স্বাধীনতা ঘোষণা এবং সশস্ত্র যুদ্ধ করে,

বাংলায় স্বাধীনতার যে বীজ বপন করেছিলেন যুগ যুগ ধরে এদেশবাসীকে তা তাদের স্বাধীনতার প্রেরণায় উজ্জীবিত করেছিল।


নিত্য নতুন সকল আপডেটের জন্য জয়েন করুন

Telegram Group Join Now
Our Facebook Page Join Now
Class 8 Facebook Study Group Join Now
Class 7 Facebook Study Group Join Now
Class 6 Facebook Study Group Join Now

Post a Comment