প্রশ্ন : রাজা গণেশ কে ছিলেন? বাংলার সমকালীন রাজনীতিতে তাঁর ভূমিকা নিরূপণ কর। অথবা, রাজা গণেশ কে ছিলেন? তার রাজত্বকাল সম্বন্ধে আলোচনা কর।
উপস্থাপনা :
খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতকের শুরুতে সুলতানী শাসনের ধারাবাহিকতা ছিন্ন করে রাজা গণেশের আবির্ভাব ও বাংলার ক্ষমতা দখল ইতিহাসের এক আলোচিত ঘটনা।
ঐতিহাসিক বেভারিজ-এর ভাষায়- Raja Kans is the most interesting figure among the kings of Bengal. প্রথম ইলিয়াস শাহী বংশের সর্বশেষ সুলতানকে,
হত্যা করে গণেশ কর্তৃক ক্ষমতা দখল এবং হিন্দু শাসন প্রতিষ্ঠা করলেও এর স্থায়িত্ব বেশিকাল হয়নি।
পরিচয় ও উত্থান:
১. রাজা গণেশের পরিচয় :
ফার্সি গ্রন্থে উল্লেখ আছে, তাঁর নাম 'কানস' যা বাংলায় কানস বা গণেশ হতে পারে। রিয়াজুস সালাতিনে বলা হয়েছে, রাজা গণেশ বাতুরিয়ার জমিদার ছিলেন, যা বর্তমানে রাজশাহী জেলার অন্তর্গত।
তাঁর বংশের চারশ বছরের জমিদারী হেতু তিনি ব্যাপক প্রভাবশালী ছিলেন। আবুল কাসিম ফিরিশতা জানান, ক্ষমতা দখলের পূর্বে গণেশ ইলিয়াস শাহী বংশের সুলতানদের আমীর ছিলেন এবং অসামান্য সামরিক শক্তির অধিকারী ছিলেন। বর্ণে তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণ ।
২. গণেশের রাজনৈতিক উত্থান :
বাংলায় ইলিয়াস শাহী সুলতানদের আমল থেকে হিন্দুরা প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে। সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহের কথিত জনৈকা হিন্দু কন্যা ফুলমতিকে বিবাহ এবং একডালা যুদ্ধে হিন্দুদের সহযোগিতা গ্রহণের ফলে হিন্দুরা সুলতানের আনুকূল্য ও রাজপদে নিয়োগ লাভ করে।
শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহের এহেন হিন্দু নীতির ফলে বাংলায় একদল শক্তিশালী হিন্দু অমাত্য শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তী শাসকদের সময় অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার সুযোগে হিন্দুরা রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। এরই পথ ধরে উত্থান ঘটে রাজা গণেশের।
ঐতিহাসিকগণ রাজা গণেশের রাজনৈতিক উত্থানের পেছনে ইলিয়াস শাহী সুলতানদের দুর্বল নীতিকে দায়ী করেছেন।
বাংলার সমকালীন রাজনীতিতে রাজা গণেশের ভূমিকা:
১. সিংহাসন দখল :
শঠতা, বিশ্বাসঘাতকতা, নিপীড়ন, ছলচাতুরী ও গুপ্তহত্যার বীভৎস পথ ধরে গণেশ ১৪১৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সিংহাসন দখল করেন। ইলিয়াস শাহী বংশের সুলতান সিকান্দার শাহের সাথে স্বীয় পুত্র গিয়াস উদ্দিন আযম শাহের গৃহযুদ্ধ বাঁধলে গণেশ গিয়াসউদ্দিনের পক্ষাবলম্বন করেন।
যুদ্ধে পিতা সিকান্দার শাহ নিহত হন এবং গিয়াস উদ্দিন আযম শাহ ১৩৯৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলার মসনদে বসেন। গিয়াস উদ্দীনের পক্ষাবলম্বন করার সুবাদে গণেশ একজন প্রভাবশালী অমাত্য হিসেবে উচ্চপদে সমাসীন হন। ক্রমশ গণেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
অবশেষে গণেশের চক্রান্তে সুলতান আযম শাহ ১৪১০ খ্রিস্টাব্দে নিহত হলে বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে।
আযম শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র শামসউদ্দিন হামযা শাহ (১৪১০-১২ খ্রি.) সিংহাসনে বসেন। কিন্তু গণেশের যড়যন্ত্রে মাত্র দুবছরের মাথায় তাঁকেও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।
হামযা শাহের ক্রীতদাস ও পালিত পুত্র বায়েজিদ গণেশের প্ররোচনায় ও সহযোগিতায় হামযা শাহকে হত্যা করে এবং সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু মাত্র দুবছর শাসনকার্য পরিচালনার পর তিনিও গণেশের চক্রান্তে নিহত হন।
বায়েজিদ শাহকে হত্যা করার পর রাজা গণেশ ১৪১৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হন। রাজা গণেশ ‘দনুজমর্দন দেব' উপাধি গ্রহণ করে বাংলার সিংহাসনে বসেন।
২. গণেশের মুসলিম নির্যাতন :
রাজা গণেশের ক্ষমতালাভ বাংলাদেশে হিন্দু প্রাধান্য সূচনা করে এবং এর ফলে ইসলাম ও মুসলমানদের ঘোর দুর্দিন শুরু হয়। তিনি মুসলমানদের ওপর চরম নির্যাতন ও নিপীড়ন শুরু করেন।
মুসলমানদের ধ্বংস সাধন করার লক্ষ্যে তাদের জায়গীর কেড়ে নেন এবং দরবেশদের হত্যা করেন। তাঁর রাজ্য থেকে ইসলামকে সমূলে উৎপাটনই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য।
৩. নূর কুতুবুল আলমের প্রতিরোধ :
রাজা গণেশ ইসলামকে উৎখাতের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ও নির্যাতন-নিপীড়ন শুরু করলে মুসলমানগণ তা প্রতিরোধ করেন।
পাণ্ডুয়ার বিখ্যাত দরবেশ নূর কুতুবুল আলম এই প্রতিরোধ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। তিনি মুসলমানদের ওপর নির্যাতন নিরসনের জন্য জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শারকীকে বাংলা আক্রমণের আহ্বান জানান ।
৪. যদুর পক্ষে সাময়িক ক্ষমতা ত্যাগ :
মুসলিম নির্যাতন প্রতিরোধের লক্ষ্যে ইব্রাহিম শার্কী বাংলা আক্রমণ করলে গণেশ ভীত হয়ে পড়ে। গণেশ ইব্রাহিম শার্কীর প্রচণ্ড শক্তির মুখে টিকতে না পেরে নূর কুতুবুল আলমের সাথে সন্ধি করেন।
সন্ধির শর্ত অনুসারে গণেশের পুত্র যদু ইসলাম গ্রহণ করেন এবং জালালউদ্দিন মোহাম্মদ নাম ধারণ করেন। গণেশ জালালউদ্দিন (যদু)-এর পক্ষে ক্ষমতা ত্যাগ করলে তিনি সিংহাসনে বসেন।
৫. গণেশের পুনরায় ক্ষমতা দখল :
ইব্রাহিম শার্কী স্বদেশে ফিরে গেলে বিদ্রোহী কুচক্রী গণেশ পুত্রের কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেন এবং তাঁকে পুনরায় হিন্দু ধর্মে প্রত্যাবর্তনের চেষ্টা চালান। পুনরায় ক্ষমতা দখলের পর গণেশ গৌরব সূচক ‘দনুজমর্দন' এবং 'চণ্ডীচরণ পরায়ণ' উপাধি গ্রহণ করেন।
৬.. মুসলিম নির্যাতন :
ক্ষমতা লাভ করে গণেশ পুনরায় অত্যাচারী হয়ে উঠেন। বিদ্রোহের আশঙ্কায় তিনি তাঁর পুত্রকে বন্দি করেন। অতঃপর শেখ নূর কুতুবুল আলমের বংশধরদের প্রতি নিদারুণ অত্যাচার শুরু করেন। তাদের সমস্ত ধনসম্পদ লুণ্ঠন ও বাজেয়াপ্ত করেন।
অন্যান্য মুসলমানদের প্রতিও তিনি অত্যাচার চালান এবং বেশ কিছু খানকাহ, মসজিদ ও প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেন।
৭. মুদ্রা জারি :
অতঃপর গণেশ তাঁর নতুন নামে (দনুজমর্দন) মুদ্রা জারি করেন। এ মুদ্রাগুলোর এক পিঠে রাজার নাম, অপর পিঠে টাকশালের নাম, তারিখ ও চণ্ডিচরণ পরায়ণস্য লেখা থাকত।
৮. জালালউদ্দিনের প্রতিরোধ ও ক্ষমতারোহণ :
জালালউদ্দিন বন্দি অবস্থায় থেকে তাঁর পিতাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করেন। অতঃপর তাঁর ছোট ভাই মহেন্দ্রদেব স্বল্পকাল রাজত্ব করেন। মহেন্দ্রদেবকে হত্যা করে জালালউদ্দিন অমাত্যদের সমর্থনে পুনরায় বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন।
৯. জালালউদ্দিনের মুসলিম শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব :
জালালউদ্দিন ক্ষমতারোহণ করে ইসলাম ধর্মেই বহাল থাকেন। এর দুটি কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, ইসলামের অন্তর্নিহিত গুণাবলির প্রতি তাঁর যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক কারণ।
তাঁর রাজ্যের চারদিকে ছিল মুসলিম রাজ্য। এমতাবস্থায় হিন্দু নামে এ অঞ্চল শাসন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই তিনি ইসলাম ধর্মে অধিষ্ঠিত থেকে মুসলিম শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার নেতৃত্ব দেন।
১০. গণেশের রাজ্য সীমা :
গণেশ মোটামুটি বিশাল এলাকার অধিপতি ছিলেন। পূর্বাঞ্চলের অধিকাংশ এলাকাই তাঁর রাজত্বের অন্তর্গত ছিল। এছাড়া বঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ, দক্ষিণ বঙ্গের অনেক অংশ তাঁর রাজ্যাধীনে ছিল।
১১. গণেশের মৃত্যু :
রিয়াজ-উস-সালাতিনের গ্রন্থকারের মতে, ১৪১৮ সালের - কোনো এক সময় গণেশের মৃত্যু হয়। তাঁর পুত্র ভৃত্যের সাথে যড়যন্ত্র করে পিতাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করেন। আর কোনো বর্ণনায় জানা যায় তাঁর পুত্র জালালউদ্দিন তাঁকে হঠাৎ আক্রমণ করে হত্যা করেছিলেন।
গণেশের চরিত্র ও কৃতিত্ব :
রাজা গণেশ ছিলেন একজন উৎপীড়ক, নিষ্ঠুর, বর্ণবাদী, বিশ্বাসঘাতক এবং ক্ষমতালোভী শাসক। সঙ্গীত শিরমনি নামক গ্রন্থে গণেশকে আগুনের সাথে তুলনা করে বলা হয়েছে ঐ আগুনে মুসলমানগণ পতঙ্গের মতো পুড়ে মরবে।
তাঁর চারিত্রিক গুণাবলি বিশ্লেষণ করলে প্রতীয়মান হয় তিনি বাংলার মুসলিম শাসনের সাময়িকভাবে একটা ছেদ টানেন। প্রাসাদ কূটনীতিতে অভিজ্ঞ গণেশ বিবেক বর্জিতভাবে ষড়যন্ত্র দ্বারা তাঁর পথের সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করছিলেন সিদ্ধহস্তে।
ইব্রাহিম শার্কীর সাথে যুদ্ধ না করা তাঁর কাপুরুষতার লক্ষণ হিসেবে বিবেচিত। চাপে পড়ে স্বীয় পুত্রকে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা এবং পরবর্তীতে দরবেশ নূর কুতুবুল আলমের মৃত্যুর পর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে ক্ষমতা দখল তাঁর চরিত্রের নিকৃষ্টতম দিক।
মুসলিম নিধনযজ্ঞ এবং মুসলিম কীর্তি ধ্বংসের মাধ্যমে তাঁর চিরাচরিত ব্রাহ্মণ্যবাদী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
উপসংহার :
১৩৩৮ থেকে ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার স্বাধীন মুসলিম শাসনের সুদীর্ঘ দুশ বছরের ইতিহাসে গণেশের উত্থান একটা চমকপ্রদ ঘটনা।
সুখময় মুখোপাধ্যায় স্বজাতীয় এ হিন্দু রাজার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেছেন, “বাংলাদেশের মধ্যযুগের ইতিহাসে যাঁদের নাম ভাস্বর অক্ষরে লেখা রয়েছে রাজা গণেশ তাঁদের মধ্যে অন্যতম।”
অনেকের
মতে, তাঁর স্বল্পকালীন রাজত্ব হিন্দুদের
ক্ষমতার যে স্বাদ এনে দেয় তাই পরবর্তী ইতিহাসের গতিপথ নির্ধারণ করে দেয়।
নিত্য নতুন সকল আপডেটের জন্য জয়েন করুন
If any objections to our content, please email us directly: helptrick24bd@gmail.com